, শুক্রবার, ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
নোটিশ :

টিকে থাকার লড়াই:জীবন বনাম প্লাস্টিক।

  • SURMA TV 24
  • Update Time : ০৪:৪১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ জুন ২০২৫
  • ১৩৭৩ Time View

সুরমা টিভি ২৪ নিউজ ডেস্ক:

আমাদের সভ্যতার ইতিহাসে প্লাস্টিক একসময়ে মানবজাতির জন্য এক যুগান্তকারী আবিষ্কার হিসেবে বিবেচিত ছিল। এটি ছিল সাশ্রয়ী, টেকসই ও বহুমুখী ব্যবহারের জন্য অনন্য এক উপাদান। কিন্তু এই উপকারী আবিষ্কারই এখন মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর একটি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য ‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়’ এবং স্লোগান ‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়, বন্ধ করার এখনই সময়’। পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলের মতো বাংলাদেশেও প্লাস্টিক দূষণ আজ এক মহাসংকট, যা শুধু পরিবেশ নয়, জীববৈচিত্র্য, জনস্বাস্থ্য এবং খাদ্য নিরাপত্তার ওপরও ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।

বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন গড়ে প্রায় এক কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে, যার মাত্র ৯ শতাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য। বাংলাদেশেও প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, এর মধ্যে মাত্র ৩৭ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা সম্ভব হয়। বাকি ৬৩ শতাংশ প্লাস্টিক নদী, খাল, বিল, সমুদ্র ও কৃষিজমিতে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে জলজ ও স্থলজ বাস্তুতন্ত্রে চরম বিপর্যয় নেমে আসে।

নদী দূষণ এখন বাংলাদেশে চরম আকার ধারণ করেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯৫ হাজারটির বেশি প্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে, যা WHO-এর নিরাপদ মাত্রার তুলনায় ৪৫ গুণ বেশি। তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদীতেও প্রতি লিটারে গড়ে ২০ হাজারটির বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা রয়েছে। এ কণাগুলো শুধু পানির গুণগত মান কমাচ্ছে না, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর দেহে জমা হয়ে খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে, যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক হুমকি। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ইলিশের ৮৫ শতাংশ নমুনার পাকস্থলীতে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। শুধু ইলিশ নয়, রুই, কাতলা, মৃগেলসহ প্রায় সব অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মাছেই এ কণা পাওয়া যাচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের তলদেশেও প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৩০০ কেজি প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়েছে, যা ডলফিন, কচ্ছপ, শার্কসহ সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য সরাসরি হুমকি। অনেক প্রাণী এ প্লাস্টিক খাদ্য হিসেবে খেয়ে মৃত্যুবরণ করছে কিংবা প্লাস্টিকে জড়িয়ে আটকে যাচ্ছে।

সুন্দরবন, যা ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য এবং বিপুল জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল, এখন প্লাস্টিক দূষণের করাল গ্রাসে আক্রান্ত। ৬০ শতাংশ এলাকায় প্লাস্টিক বর্জ্য শনাক্ত হয়েছে। বন বিভাগের তথ্য অনুসারে, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ১৮ শতাংশ ও চিত্রা হরিণের ২৫ শতাংশ মৃত্যুর পেছনে প্লাস্টিকের পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। প্লাস্টিকের কারণে মাটির উর্বরতা হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট জানায়, প্লাস্টিক দূষিত এলাকায় ফসল উৎপাদন গড়ে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। মাটির ছিদ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পানি ও পুষ্টি উপাদান প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়েছে।

প্লাস্টিক পোড়ানোর মাধ্যমে নির্গত ডাইঅক্সিন, ফুরান ও বিসফেনলে জাতীয় বিষাক্ত পদার্থ সরাসরি ফুসফুস, কিডনি, লিভার ও অন্তঃস্রাবী গ্রন্থি আক্রান্ত করে। মাইক্রোপ্লাস্টিক ও ন্যানোপ্লাস্টিক কণা ডিএনএতে মিউটেশন ঘটিয়ে ক্যান্সার পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে। এ কণাগুলো মানুষের হরমোন সিস্টেম, স্নায়ুতন্ত্র ও প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করতে পারে। এ ছাড়া, নাইলোনেজ এনজাইমের মাধ্যমে প্লাস্টিক ভাঙনের সময় মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়, যা একটি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস হিসেবে পৃথিবীর উষ্ণায়নে ভূমিকা রাখে।

নগর জীবনে প্লাস্টিকের দখলদারি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে শহরের পরিকাঠামো পর্যন্ত এর ছাপ স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। প্রতিদিন ঢাকা শহরে গড়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার বেশিরভাগই একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক যেমন পলিথিন ব্যাগ, পানির বোতল, খাবারের প্যাকেট ইত্যাদি। এসব বর্জ্য ব্যবহারের পরপরই ডাস্টবিন, ড্রেন, খাল ও নদীতে জমা হয়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে এবং জলাবদ্ধতা, দুর্গন্ধ, রোগজীবাণু ছড়ানোর কারণ হচ্ছে। ফাস্টফুড, হোম ডেলিভারি, অনলাইন শপিং, এমনকি ব্যক্তিগত যত্ন ও নির্মাণসামগ্রীতেও প্লাস্টিকের বহুল ব্যবহার নগরজীবনের প্রতিটি স্তরে এটি একটি নির্ভরশীল উপাদানে পরিণত করেছে। অথচ এ প্লাস্টিক ব্যবহারের পেছনে সঠিক রিসাইক্লিং ব্যবস্থা না থাকায় তা পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনায় ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করছে। প্লাস্টিক পোড়ালে নিঃসৃত বিষাক্ত গ্যাস যেমন বাতাস দূষণ করে, তেমনি নদী বা মাটিতে জমে জলজ ও স্থলজ জীববৈচিত্র্যের ওপর চরম হুমকি তৈরি করে। ফলে বলা যায়, আজ শহরের প্রতিটি অলিগলিতে প্লাস্টিকের এক নীরব দখলদারি চলছে।

Popular Post

টিকে থাকার লড়াই:জীবন বনাম প্লাস্টিক।

Update Time : ০৪:৪১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ জুন ২০২৫

সুরমা টিভি ২৪ নিউজ ডেস্ক:

আমাদের সভ্যতার ইতিহাসে প্লাস্টিক একসময়ে মানবজাতির জন্য এক যুগান্তকারী আবিষ্কার হিসেবে বিবেচিত ছিল। এটি ছিল সাশ্রয়ী, টেকসই ও বহুমুখী ব্যবহারের জন্য অনন্য এক উপাদান। কিন্তু এই উপকারী আবিষ্কারই এখন মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর একটি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য ‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়’ এবং স্লোগান ‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়, বন্ধ করার এখনই সময়’। পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলের মতো বাংলাদেশেও প্লাস্টিক দূষণ আজ এক মহাসংকট, যা শুধু পরিবেশ নয়, জীববৈচিত্র্য, জনস্বাস্থ্য এবং খাদ্য নিরাপত্তার ওপরও ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।

বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন গড়ে প্রায় এক কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে, যার মাত্র ৯ শতাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য। বাংলাদেশেও প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, এর মধ্যে মাত্র ৩৭ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা সম্ভব হয়। বাকি ৬৩ শতাংশ প্লাস্টিক নদী, খাল, বিল, সমুদ্র ও কৃষিজমিতে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে জলজ ও স্থলজ বাস্তুতন্ত্রে চরম বিপর্যয় নেমে আসে।

নদী দূষণ এখন বাংলাদেশে চরম আকার ধারণ করেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯৫ হাজারটির বেশি প্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে, যা WHO-এর নিরাপদ মাত্রার তুলনায় ৪৫ গুণ বেশি। তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদীতেও প্রতি লিটারে গড়ে ২০ হাজারটির বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা রয়েছে। এ কণাগুলো শুধু পানির গুণগত মান কমাচ্ছে না, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর দেহে জমা হয়ে খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে, যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক হুমকি। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ইলিশের ৮৫ শতাংশ নমুনার পাকস্থলীতে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। শুধু ইলিশ নয়, রুই, কাতলা, মৃগেলসহ প্রায় সব অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মাছেই এ কণা পাওয়া যাচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের তলদেশেও প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৩০০ কেজি প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়েছে, যা ডলফিন, কচ্ছপ, শার্কসহ সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য সরাসরি হুমকি। অনেক প্রাণী এ প্লাস্টিক খাদ্য হিসেবে খেয়ে মৃত্যুবরণ করছে কিংবা প্লাস্টিকে জড়িয়ে আটকে যাচ্ছে।

সুন্দরবন, যা ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য এবং বিপুল জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল, এখন প্লাস্টিক দূষণের করাল গ্রাসে আক্রান্ত। ৬০ শতাংশ এলাকায় প্লাস্টিক বর্জ্য শনাক্ত হয়েছে। বন বিভাগের তথ্য অনুসারে, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ১৮ শতাংশ ও চিত্রা হরিণের ২৫ শতাংশ মৃত্যুর পেছনে প্লাস্টিকের পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। প্লাস্টিকের কারণে মাটির উর্বরতা হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট জানায়, প্লাস্টিক দূষিত এলাকায় ফসল উৎপাদন গড়ে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। মাটির ছিদ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পানি ও পুষ্টি উপাদান প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়েছে।

প্লাস্টিক পোড়ানোর মাধ্যমে নির্গত ডাইঅক্সিন, ফুরান ও বিসফেনলে জাতীয় বিষাক্ত পদার্থ সরাসরি ফুসফুস, কিডনি, লিভার ও অন্তঃস্রাবী গ্রন্থি আক্রান্ত করে। মাইক্রোপ্লাস্টিক ও ন্যানোপ্লাস্টিক কণা ডিএনএতে মিউটেশন ঘটিয়ে ক্যান্সার পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে। এ কণাগুলো মানুষের হরমোন সিস্টেম, স্নায়ুতন্ত্র ও প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করতে পারে। এ ছাড়া, নাইলোনেজ এনজাইমের মাধ্যমে প্লাস্টিক ভাঙনের সময় মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়, যা একটি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস হিসেবে পৃথিবীর উষ্ণায়নে ভূমিকা রাখে।

নগর জীবনে প্লাস্টিকের দখলদারি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে শহরের পরিকাঠামো পর্যন্ত এর ছাপ স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। প্রতিদিন ঢাকা শহরে গড়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার বেশিরভাগই একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক যেমন পলিথিন ব্যাগ, পানির বোতল, খাবারের প্যাকেট ইত্যাদি। এসব বর্জ্য ব্যবহারের পরপরই ডাস্টবিন, ড্রেন, খাল ও নদীতে জমা হয়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে এবং জলাবদ্ধতা, দুর্গন্ধ, রোগজীবাণু ছড়ানোর কারণ হচ্ছে। ফাস্টফুড, হোম ডেলিভারি, অনলাইন শপিং, এমনকি ব্যক্তিগত যত্ন ও নির্মাণসামগ্রীতেও প্লাস্টিকের বহুল ব্যবহার নগরজীবনের প্রতিটি স্তরে এটি একটি নির্ভরশীল উপাদানে পরিণত করেছে। অথচ এ প্লাস্টিক ব্যবহারের পেছনে সঠিক রিসাইক্লিং ব্যবস্থা না থাকায় তা পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনায় ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করছে। প্লাস্টিক পোড়ালে নিঃসৃত বিষাক্ত গ্যাস যেমন বাতাস দূষণ করে, তেমনি নদী বা মাটিতে জমে জলজ ও স্থলজ জীববৈচিত্র্যের ওপর চরম হুমকি তৈরি করে। ফলে বলা যায়, আজ শহরের প্রতিটি অলিগলিতে প্লাস্টিকের এক নীরব দখলদারি চলছে।