সুরমা টিভি ২৪ নিউজ ডেস্ক:
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের আগ্রাসী ভূমিকায় আবারও উত্তাল হয়ে উঠেছে কূটনৈতিক মঞ্চ। ফিলিস্তিন, লেবানন, ইয়েমেন ও সিরিয়ার পর এবার ইরান হয়ে উঠেছে নতুন লক্ষ্য। সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় চালানো হামলা শুধু একটি দেশ নয়, গোটা অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
ইসরায়েলের বক্তব্য, এটি তাদের ‘নিরাপত্তার স্বার্থে গৃহীত প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ’। যুক্তি হিসেবে তারা বারবার বলে আসছে- ইরান শিগগিরই পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই হুঁশিয়ারি কি সত্যি নাকি শুধুই দীর্ঘদিনের এক রাজনৈতিক কৌশল?
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত তিন দশক ধরেই দাবি করে আসছেন- ইরান কয়েক মাস কিংবা বছরেই পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলবে। কিন্তু এত বছরেও সেই বোমার অস্তিত্বের প্রমাণ মেলেনি। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) ও জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণেও তার কোনো সত্যতা নেই।
গত সপ্তাহে ইসরায়েলের চালানো হামলার জবাবে ইরানও পালটা আঘাত হেনেছে, যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাবস্থা প্রায় তৈরি হয়ে গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে চললে পরিস্থিতি শুধু ইরান- ইসরায়েলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, তা পুরো অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এদিকে এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই এবার পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে হুমকি দিয়ে বসলেন ইসরায়েলের সাবেক উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী মেইর মাসরি। এক্স প্ল্যাটফর্মে তিনি বলেন, ইরানের পর এবার আমরা পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের চিন্তা করছি। পাকিস্তান ইরান থেকে খুব দূরে নয়।
মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনার মধ্যে এই বক্তব্য শুধু একটি কূটনৈতিক বার্তাই নয়, বরং গোটা মুসলিম বিশ্বের জন্য এক ধরনের মৌন হুমকি।
তবে ইসরায়েলের এমন অবস্থানকে একপাক্ষিক বলেই মনে করেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। কারণ, ইসরায়েল নিজেই একটি সুপরিকল্পিত পারমাণবিক কর্মসূচি পরিচালনা করছে, যা সর্বজনবিদিত হলেও তারা কখনো তা স্বীকার করেনি, অস্বীকারও করেনি। এটি যেন ‘সবার জানা গোপন সত্য’।
আন্তর্জাতিক কৌশলগত গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI) এর মতে : ইসরায়েলের হাতে রয়েছে প্রায় ৯০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড, রয়েছে ৩০০টিরও বেশি অস্ত্র তৈরির উপযুক্ত তেজস্ক্রিয় উপাদান।
ইসরায়েল ১৯৫৮ সালেই ডিমোনা-তে গোপন পারমাণবিক স্থাপনা শুরু করে। ধারণা করা হয়, ১৯৬৬-৬৭ সালেই ইসরায়েল প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে এবং ১৯৭৯ সালে তারা গোপনে বায়ুমণ্ডলীয় পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়, যদিও তা অস্বীকার করা হয়
এছাড়া ইসরায়েল আজও পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি)-তে স্বাক্ষর করেনি। তারা মধ্যপ্রাচ্যে গণবিধ্বংসী অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল তৈরির প্রচেষ্টারও বিরোধিতা করে। অথচ অন্যদের সেই চুক্তির আওতায় আনতে তারা জাতিসংঘে নিয়মিত আহ্বান জানায়।
ইসরায়েলের আচরণে যে কৌশলটি স্পষ্ট, তা হলো- তারা মধ্যপ্রাচ্যে একক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে চায়। এজন্য তারা অন্য কোনো দেশের (বিশেষ করে মুসলিম দেশের) সামরিক বা পারমাণবিক উন্নয়ন সহ্য করতে চায় না। এই লক্ষ্যেই তারা ইরানকে ঠেকাতে চায়, পাকিস্তানকেও সতর্ক করে।
ইসরায়েলের অবস্থান একদিকে আত্মরক্ষার দাবি করে, অন্যদিকে গোপনে শক্তি সঞ্চয় করে প্রতিপক্ষকে দুর্বল রাখার কৌশল নেয়। এই দ্বিচারিতা শুধু আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেই হুমকিতে ফেলছে না, বরং আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা ও সমতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত, ইরান বা পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রের পাশাপাশি ইসরায়েলের গোপন পারমাণবিক সক্ষমতারও নিরপেক্ষ তদন্ত ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, অন্যথায় বিশ্ববাসী আবারও সেই ভয়াবহ ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’-এর শিকার হবে।