সুরমা টিভি ২৪ নিউজ ডেস্ক:
নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সুন্দরবনের নদী ও খাল থেকে কাঁকড়া শিকার করে ট্রলারে ভরে ফিরছিলেন একদল জেলে। ট্রলার যখন লোকালয়ের কাছাকাছি, তখন হঠাৎ হাজির বন বিভাগ ও কোস্টগার্ডের যৌথ টহল দল। জেলেরা তড়িঘড়ি করে ট্রলার তীরে ঠেকিয়ে কাঁকড়া ফেলে পালিয়ে যান। পরে পরিত্যক্ত ট্রলার থেকে উদ্ধার হয় ৭৩০ কেজি কাঁকড়া। গতকাল শনিবার বিকেলে কয়রা উপজেলার চরামুখা গ্রামসংলগ্ন কপোতাক্ষ নদের তীরে এ ঘটনা ঘটে।
আজ রোববার সকালে জব্দ কাঁকড়াগুলো কয়রার বন আদালতে নেওয়া হয়। দুপুর ১২টার দিকে কয়রা বন আদালত এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আদালত ভবনের পুরোনো একটি কক্ষের মধ্যে অনেকগুলো বস্তা আর প্লাস্টিকের ঝুড়িতে রাখা জব্দ কাঁকড়াগুলো। পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কয়েকজন বনকর্মী।
আদালত ভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বন বিভাগের কোবাদক ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানালেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারেন, কিছু অসাধু জেলে সুন্দরবন থেকে কাঁকড়া ধরে কপোতাক্ষ নদ ধরে লোকালয়ে ফিরছেন। এরপর কোস্টগার্ডের সঙ্গে যৌথ অভিযান চালিয়ে চরামুখা গ্রামের কাছে একটি সন্দেহজনক ট্রলার দেখতে পান তাঁরা। কিন্তু টহল বোট কাছে পৌঁছানোর আগেই জেলেরা তীরে ভিড়িয়ে ট্রলার ফেলে পালিয়ে যান। পরিত্যক্ত ট্রলারে তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া যায় ৭৩০ কেজি জীবিত কাঁকড়া।
সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, এখন সুন্দরবনের কাঁকড়ার ব্যবসা মাছের চেয়ে অনেক বড় মুনাফার ব্যবসা। বন-উপকূলজুড়ে একটি বড় সিন্ডিকেট কাঁকড়া শিকারে জড়িত। জোড়শিং, ঘড়িলাল, বানিয়াখালী, দেউলিয়া বাজারসহ বিভিন্ন আড়তে প্রতিদিন শত শত মণ কাঁকড়া বিক্রি হয়। যদিও এখন শিকার নিষিদ্ধ, জেলেরা বন থেকে অবৈধভাবে কাঁকড়া শিকার করছেন।
আড়তে অবাধে কাঁকড়া বেচাকেনা
আজ সকালে কয়রা উপজেলার কয়েকটি কাঁকড়ার আড়তে দেখা গেছে, বস্তায় বস্তায় কাঁকড়া এসেছে বন থেকে। আড়তে কাঁকড়া পরিমাপ ও দড়ি দিয়ে বাঁধার কাজ চলছে। কয়রার কাশির হাটখোলা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ট্রলারবোঝাই কাঁকড়া পার্শ্ববর্তী শ্যামনগর উপজেলার আড়তে যাচ্ছে। কাঁকড়ার বস্তা ট্রলারে ওঠানোর ফাঁকে এক ব্যক্তি জানালেন, ‘এখন সুন্দরবনে ঢোকা নিষিদ্ধ, তবু আমরা বনে ঢুকে কাঁকড়া ধরে আনি। বন্ধের সময় সবকিছু একটু ম্যানেজ করেই করতে হয়। ধরা খায় অল্প, বেশির ভাগই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে।’
বন বিভাগের নিয়ম অনুযায়ী, ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনে মাছ ধরা, কাঁকড়া আহরণ ও পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ; কারণ, এটি মাছ ও বন্য প্রাণীর প্রজননকাল। অথচ ঠিক এই সময়েই বেড়ে যাচ্ছে বন অপরাধ। একের পর এক অভিযানে ধরা পড়ছে ভয়াবহ চিত্র। ২৪ জুলাই বয়াশিংয়ে, ২২ জুলাই কালাবগীতে, ১৭ জুলাই দুবলায় এবং ১৪ জুলাই ভূতুমারী খালে বিপুল পরিমাণ কাঁকড়া ও শিকারের সরঞ্জাম জব্দ হলেও শিকারিরা প্রত্যেকবারই পালিয়ে গেছেন। এসব ঘটনা বন বিভাগের জন্য বড় উদ্বেগের বার্তা দিচ্ছে।
কয়রার কয়েকজন কাঁকড়া ব্যবসায়ী জানান, উপজেলায় প্রায় ১০৫টি কাঁকড়া বিক্রির ডিপো আছে। জেলেরা কাঁকড়া শিকার করে বনে বসেই তা বিক্রি করে দিচ্ছেন দ্বিতীয় কোনো পক্ষের কাছে। আর দ্বিতীয় পক্ষের লোকজন নার্সিং পয়েন্ট ও ঘেরের কাঁকড়া বলে তাঁদের কাছে কাঁকড়া বিক্রি করছেন। তাঁরা (ব্যবসায়ীরা) কাঁকড়া কিনে ঢাকায় রপ্তানিকারকদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন।
উপকূল ও সুন্দরবন সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব সাইফুল ইসলাম বলেন, একসময় ছোট কাঁকড়ার বাজার ছিল না, এখন কোনো বাছবিচার ছাড়াই ছোট-বড় সব কাঁকড়া ধরা হচ্ছে। বাঁশের তৈরি ‘চারো’ বা ‘আটোন’ ফাঁদ দিয়ে নির্বিচার শিকার চলছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, সুন্দরবন সোনার ডিম পাড়া হাঁস, এটি ধ্বংস করলে শেষ ক্ষতিটা গরিব জেলেদেরই হবে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হলে কাঁকড়ার অস্তিত্বই শেষ।
পশ্চিম সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, ‘বনরক্ষীদের বোটের শব্দ শুনলেই অপরাধীরা জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে। বন বিভাগের টহল দল নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে একাধিক নৌকা ও বিপুল পরিমাণ কাঁকড়া জব্দ করে নদীতে অবমুক্ত করা হয়েছে। আজ বেলা দেড়টায় আদালতের নির্দেশে ৭৩০ কেজি কাঁকড়া শাকবাড়িয়া নদীতে অবমুক্ত করা হয়েছে। তবে লোকালয়ের বাজারে তদারকি কম থাকায় কিছু কাঁকড়া ডিপোতে চলে যেতে পারে। তাই বাজার নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি উপকূলীয় উপজেলাগুলোর প্রশাসনকে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছি।’