আহমদ মারুফ, সিলেট
সিলেটের পাথর রাজ্যে এখন আর পাথর নেই। পাথর খেকোদের ছোবলে বিপন্ন ভোলাগঞ্জ ‘সাদাপাথর’। এক বছর আগেও যেখানে ছিল পাথরের স্তূপ সেখানে এখন ধুধু মাঠ। দিনরাত শত শত নৌকা দিয়ে প্রকাশ্যে বালু-পাথর লুটপাট হলেও প্রশাসন নির্বিকার। একাধিকবার অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান। তিনি বলেছেন, ‘আমি উপদেষ্টা হয়েও পাথর উত্তোলন ঠেকাতে পারলাম না।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে নির্বিচারে চলে সাদাপাথরের পাথর লুট। গত এক সপ্তাহে শেষ হওয়া সাদাপাথরে মরণ কামড় দেয় লুটেরা। লুটপাটে যেন সবাই ঐক্যবদ্ধ। তবে, লুটের নেতৃত্বে ছিল স্থানীয় বিএনপি ও যুবদলের নেতারা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ছিলেন লুটের নেপথ্য কারিগর। তাই একসময় রাতের আধাঁরে চুরি হলেও এখন দিনদুপুরে চলছে পাথর লুট। প্রতিদিন লুট হচ্ছে কয়েক কোটি টাকার পাথর। প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে বালু-পাথর লুট করে নিয়ে গেলেও তাদের যেন কিছু করার নেই।
তারা বলছেন, প্রশাসনের ব্যর্থতা আর প্রকাশ্য মদদে এই লুটপাট হচ্ছে। সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্রের কাছাকাছি তিনটি বিজিবি ক্যাম্প ও একটি থানা থাকলেও লুট ঠেকাতে কি ভূমিকা রাখতে পারছে না? পরিবেশবাদীসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের মন্তব্য, সাদাপাথর লুট ঠেকাতে প্রশাসন কি ব্যর্থ?
স্থানীয়রা জানান, গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই শুরু হয় এই লুটপাট। পরে স্থানীয় লোকজন ও সেনাবাহিনীর কারণে সাময়িক বন্ধ হলেও সুযোগ বুঝে চলে এই লুটপাট। বিভিন্ন সময়ে প্রশাসন লোক দেখানো অভিযান চালালেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এক সপ্তাহ লুটপাট হলে অভিযান হয় একদিন আর ওই দিন সহ বাকি ৬ দিনই চলে এই লুটপাট। যেখানে পাথর কেনাবেচা হয় এবং যেদিক দিয়ে গাড়িতে করে পাথর যায়, সেদিকে অভিযান না হওয়াতে এই লুটপাট বন্ধ হচ্ছে না বলে দাবি করছেন এলাকাবাসী। আর এই কারণে এখন বিলীনের পথে রয়েছে ‘সাদাপাথর’।
সরেজমিনে সাদাপাথর ঘুরে দেখা যায়, সাদাপাথরের প্রধান স্পটে পর্যটকরা এসে সাঁতার কাটছেন আর তাদের পাশেই বারকি ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা দিয়ে চলছে অবাধে পাথর লুট। যে যে রকম পারছে, সেরকম করে পাথর লুট করে নৌকায় তুলছে আর নিয়ে যাচ্ছে। প্রায় কয়েক শতাধিক নৌকা করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এই পাথর। যেন এটি তাদের বহন করার জন্য বৈধ কোনো জিনিস।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রের ধলাই নদীর উৎসমুখ থেকে শত শত নৌকা দিয়ে লুট হচ্ছে পাথর। মূল স্পটের বাম পাশের বড় বড় পাথর নেই। কোথাও কোথাও বালুচর জেগে উঠেছে। যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি করে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি করা হয়েছে। বড় পাথরের পাশাপাশি ছোট-ছোট পাথরও লুট হয়ে গেছে। প্রকাশ্যে দিবালোকে পাথর নিয়ে যাচ্ছে। এতো লুটপাট তারপরও বিজিবি, পুলিশ, প্রশাসন যেন সবাই নীরব দর্শক। এছাড়াও পাথরবোঝাই শত শত নৌকার মাঝে পর্যটকবাহী নৌকাও ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। ফলে পাথর রাজ্যের সৌন্দর্য হারিয়েছে। যার ফলে এ পর্যটন স্পটের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন পর্যটকরা। স্থানীয় বাসিন্দারা প্রতিবাদ করেও কোনো ফল পাননি। বরং যত সময় যাচ্ছে ততই যেন বেপোরোয়া হয়ে উঠছে লুটপাটকারিরা।
যে কারণে পাথর লুটপাট বন্ধ হয় না
সাদাপাথর লুট ঠেকাতে প্রশাসনের সক্রিয় কোনো ভূমিকা না থাকার কারণে লুটপাট বন্ধ হচ্ছে না বলে অভিমত স্থানীয়দের। স্থানীয় বাসিন্দা অ্যাডভোকেট ফরহাদ খন্দকার বলেন, ‘সাদাপাথর লুটপাট করছে কয়েক হাজার মানুষ। সাদাপাথর রক্ষায় প্রশাসন নিষ্ক্রিয়। সেখানে প্রশাসন ১৫ দিনে, ২০ দিনে একবার অভিযান দেয়। অভিযান দিয়ে তারা হাইলাইট করে যে আমরা অভিযান দিলাম। একবার অভিযান দিয়ে আরেকবার দিতে গিয়ে দেখা যায় তারা বিভিন্ন বাহিনীর সাথে সমন্বয় করতে করতেই আরো ১৫ দিন চলে যায়। আর এই ১৫ দিনেই ১৫ কোটি টাকার পাথর লুট হয়ে যায়।’
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহার বলেন, ‘আমরা ডিসি অফিসে কথা বলছি, আমরা খুব দ্রুত হয়তো বা এই সপ্তাহের মধ্যে আশা করছি আবার ক্রাশারগুলোতে অভিযান চালাব। আগের বার আমরা অনেকটা শক্ত অভিযানে ছিলাম। পরবর্তীতে পরিবহন শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এরপর থেকেই এই লুটপাট হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘সোমবারও তারা সাদাপাথরে সাড়ে ৪ ঘণ্টা অভিযান চালিয়েছেন। গত মঙ্গলবার থেকে সোমবার পর্যন্ত মোট ৪ দফা অভিযান চালানো হয়েছে।
লুটপাট কেন বন্ধ হচ্ছে না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মোবাইল কোর্ট তো ২৪ ঘণ্টা চালানো যায় না। তাই বন্ধ করা যাচ্ছে না পাথর চুরি। তবে তারা এ ব্যাপারে সতর্ক আছেন।’
সিলেটের পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আব্দুল করিম কিম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, প্রশাসনের নির্লিপ্ত ভূমিকাতেই সাদাপাথর শেষ হয়ে গেছে। বিগত এক বছর ধরে গণমাধ্যমে অসংখ্য প্রতিবেদন ও পরিবেশকর্মীদের সতর্কতা উপেক্ষা করে পাথরখেকোদের লুটপাটের স্বগরাজ্যে পরিণত করা হয় সীমান্তবর্তী ধলাই নদের উৎসমুখ। পর্যটকরা ধলাই নদের উৎসমুখে উজান থেকে গড়িয়ে আসা পাথরের যে সৌন্দর্য অবলোকন করতে বহুদূর থেকে ছুটে আসতেন, সেখানে এখন ধুধু বালুচর। পাথর খেকোদের সৃষ্ট গর্তে মরণফাঁদ তৈরি হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার জানান, ‘আসলে সাদাপাথর ইসিএ-ভুক্ত এলাকা না হওয়ায় আমরা সেখানে গিয়ে কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে পারছি না। তবুও আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে অভিযানে সহযোগিতা করছি।’
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ জানান, ‘সাদাপাথর রক্ষার্থে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। কিন্তু কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না।’ আগে এটি রক্ষা করতে পারলেও এখন কেন পারছেন না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, ‘আমরা নিয়মিত অভিযান দিচ্ছি।
আহমদ মারুফ