আহমদ মারুফ, সিলেট নগরের প্রবেশমুখ।
ঐতিহাসিক কীনব্রিজ ও সার্কিট হাউজ। উত্তর-পশ্চিমে শারদা স্মৃতি ভবন। দক্ষিণে চাঁদনী ঘাটের সিঁড়ি এবং মাঝামাঝি নিশ্চপ ‘আলী আমজাদের ঘড়ি’ দাঁড়িয়ে আছে। সিলেট শহরে ঢুকতে আপনাকে স্বাগত জানানোর দায়িত্ব পালন করে আসছে শত বছর থেকে। আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটের ইতিহাসে অন্যতম স্থান করে নিয়েছে ৩৭ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন ঘড়ি ঘর হিসেবে পরিচিত এই ঘড়ি।
অতীতে খেয়া পারাপার হয়ে এবং চলতি শতাব্দীতে কীনব্রিজ পেরিয়ে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন সিলেট শহরে এসেছেন এবং আসছেন। তাদের অনেকেই আন্দাজ করতে পারছেন সময়ের ব্যবধানে বৃটেনের বিগবেন ঘড়ির আদলে নির্মিত আলী আমজাদের ঘড়ির নান্দনিকতা। হাতে হাতে ঘড়ি, দেয়ালে দেয়ালে ঘড়ি আর ফেরি করে ঘড়ি বিক্রির আমলেও মানুষ সোয়া শতাব্দীর ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী আলী আমজাদের ঘড়ির ঘন্টা ধ্বনি শুনতে চায়। অথচ ঘড়িটি আজ অসহায়। কালের বিবর্তনে, প্রশাসনের বেপরোয়া ভূমিকায় হারিয়ে ফেলছে তার শত বছরের ঐতিহ্য। আলী আমজাদের ঘড়িঘরের বেষ্টনীর ভেতরেই জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণে নির্মিত হচ্ছে স্মৃতিফলক ‘স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্প’। ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা আড়াল করে স্মৃতিফলক নির্মাণে সিলেটে চলছে সমালোচনা। নতুন করে স্থাপনা নির্মাণের ফলে ঘড়িঘরের সৌন্দর্য নষ্টের অভিযোগ উঠেছে।
প্রতিবাদ জানিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেছে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা, সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন, পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্ট।
সিলেটের প্রতীক হিসেবে পরিচিত ‘আলী আমজাদের ঘড়ি’ ঘরের বেষ্টনীর মধ্যেই নির্মাণ করা হচ্ছে স্মৃতিফলক। এতে ঘড়িঘরের প্রকৃত স্থাপত্যশৈলী আড়ালে পড়ে যাচ্ছে। এমনটাই দাবি সমালোচনাকারীদের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের স্মরণে প্রত্যেকের জন্য আলাদাভাবে ঘটনাস্থলে একই নকশায় ‘স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্প’নামে স্মৃতিফলক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সিলেট নগরে চারজন শহীদের স্মরণে এমন স্মৃতিফলক নির্মাণের কাজ গত জুলাই মাসে শুরু হয় এবং আগস্ট মাসে শেষ হওয়ার কথা। নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন। সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানায়, স্মৃতিফলক নির্মাণের স্থান চূড়ান্ত করতে একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। বিশেষত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শহীদ হওয়ার স্থান দেখিয়ে দিয়েছেন। সে অনুযায়ী ঘটনাস্থল ও ঘটনাস্থলের কাছাকাছি স্মৃতিফলক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেখানে দুই শহীদ স্মরণে স্মৃতিফলক নির্মিত হচ্ছে।
মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, ঘড়িঘরের তোপখানামুখী সড়কের সামনের দিকে স্মৃতিফলক নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ অংশের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।
তখন ১৮৭৪ সাল। বৃটিশ আমল। ইংরেজ বড় লাট নর্থব্রুক সিলেটে আসবেন। চারদিকে খবর চলে গেছে সাড়া পড়ে গেছে সবখানে। সবার মুখে একই কথা ‘বড়লাট আসবেন’ নর্থব্রুক আসবেন। এ মহান নেতাকে কিভাবে স্বাগত জানানো যায়, সম্মান করা যায় কিভাবে। এ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সচেতন মহল। বড়লাট জাহাজ থেকে নেমে সিলেট শহরে নিরাপদে পা রাখবেন তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হল সিঁড়ি তৈরি করার। আরো চমকপ্রদ কিছু করতে হবে। তাক লাগিয়ে দিতে হবে বড়লাট নর্থব্রুক। আর এমন কিছু করার উদ্যোগ নিলেন মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ার পৃথিমপাশার জমিদার নবাব আলী আমজাদ। বৃটিশ স্থাপনার অনুসরণে নির্মাণ করা হলো একটি ঘড়ি। মানে আলী আমজাদের ঘড়ি। ঘড়ি ঘরের উত্তর-দক্ষিণ প্রান্তে তাম্র ধাতব বিরাট গোলাকার সাদা বৃত্তে রোমান সংখ্যায় নিমির্ত হয়েছে দু’টি ঘড়ি। ঘড়ির ঘটি তৈরি হয়েছে আটটি লোহার পিলার দিয়ে। পিলারগুলো নিচের আটটি কোণ তৈরি করে উপরে উঠেছে। যা লোহার কাঠামো দিয়ে তৈরি। কথিত আছে যে, দিল্লির চাঁদনী ছঁকে শাহজাদী জাহানারার স্থাপিত ঘড়িঘর দেখে মুগ্ধ হন আলী আমজাদ। তার ইচ্ছা অনুযায়ী অনুরূপ একটি ঘড়িঘর সুরমা নদীর তীরে কীনব্রিজের পাশে নির্মাণ করেন। আজ সেই ঐতিহাসিক ঘড়িঘর কালের সাক্ষী। সিলেট নগরীর প্রবেশমুখে সুরক্ষিত এই ঘড়িঘর নবাব আলী আমজাদের নাম ও দানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিটি প্রহর প্রতিধ্বনিত করছে। দেশ-বিদেশে প্রশংসনীয় ঐতিহ্যবাহী নবাব আলী আমজাদের ঘড়িটির দুর্দশা পাকিস্তান আমল থেকে শুরু হয়। অবহেলা আর উদাসীনতার শিকার এই ঘড়িটি প্রায় সময় বিকল হয়ে পড়ছে আবার মেরামতও করছে সিটি কর্পোরেশন।
পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্ট্রের স্ট্রাস্টি আবদুল করিম কিম বলেন, সিলেট শহরের প্রাচীনতম ও প্রতীকখ্যাত স্থাপত্য ‘আলী আমজাদের ঘড়ি’ কেবল একটি স্থাপনা নয় এটি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও পরিচয়ের প্রতীক। শতবর্ষ অতিক্রান্ত এই স্থাপনাটি সিলেটকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পরিচিত করেছে। সুরমা নদীর তীরে অবস্থিত এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য কেবল একটি ঘড়িঘর নয়, বরং সিলেটের অস্তিত্ব, ইতিহাস ও নাগরিক ঐতিহ্যের দৃশ্যমান প্রতীক।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাই রাফিন সরকার বলেন, ‘কমিটির সিন্ধান্ত অনুযায়ী ঘটনাস্থালের পাশেই ফলক নির্মিত হচ্ছে। এখানে নিরাপত্তা ও পথচারীদের চলাচল নির্বিঘ্ন রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়েছে। ঘড়িঘরের সৌন্দর্য অক্ষুণ্ন রাখতে ফলকের সঙ্গে ঘড়িঘরও নতুনভাবে রং করা হবে।’