সুরমা টিভি ২৪ নিউজ ডেস্ক:
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার মাত্র ১০ মাসের মাথায় কালোটাকা সাদা করার সুবিধা পুনর্বহাল করায় দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সরকারি নীতির এই আকস্মিক ইউটার্নে হতবাক হয়েছেন অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাধারণ করদাতারা।
সোমবার (২ জুন) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণাকালে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, নির্দিষ্ট হারে কর পরিশোধের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ থাকছে এই বাজেটে। অর্থাৎ কালোটাকা বিনা জবাবদিহিতে বৈধ করার যে সুবিধা আগের সরকার দিয়েছিল, সেটিই মূলত বহাল রাখছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।
এই ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক সমাজ ও অর্থনীতিবিদদের কড়া প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এই সিদ্ধান্তকে দুর্নীতিবান্ধব এবং কর ন্যায়বিচারের পরিপন্থি বলে আখ্যা দিয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বহাল রাখা ‘জুলাই আন্দোলনের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক’ বলে মন্তব্য করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
মঙ্গলবার (৩ জুন) বাজেট-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘জুলাই আন্দোলন হয়েছিল বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে। অথচ বাজেটে কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ রেখে সেই প্রত্যয়কেই নস্যাৎ করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এই সুযোগ নৈতিক করদাতাদের প্রতি অবিচার, যা বৈধ আয় করা মানুষদের প্লট বা ফ্ল্যাট কেনা কঠিন করে দেবে। এছাড়া এতে রাজস্ব আদায়ের খুব বেশি সম্ভাবনাও নেই।’
ফাহমিদা খাতুন আরও বলেন, ‘অপ্রদর্শিত আয় দিয়ে ভবন বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার সুযোগ সমাজে আরও বৈষম্য তৈরি করবে। কালোটাকা সাদা করার নীতি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, আমরা এটি সমর্থন করি না।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে আখ্যা দিয়েছে ‘অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধানবিরোধী’।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকার দুর্নীতিবিরোধী সংস্কারের অঙ্গীকার উপেক্ষা করে রিয়েল এস্টেট লবির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।’ সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অনুপার্জিত আয় রাষ্ট্র দ্বারা বৈধ হতে পারে না। অথচ এই সুযোগ সৎ করদাতাদের প্রতি অবিচার সৃষ্টি করছে এবং ভবিষ্যৎ দুর্নীতিকে উৎসাহ দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘যদি সরকার সত্যিই দুর্নীতি প্রতিরোধে আন্তরিক হয়, তাহলে কালোটাকা সাদা করার মতো সুবিধা কোনোভাবেই দেওয়া যায় না। এটা জনআস্থার পরিপন্থি এবং আইনবহির্ভূত আয়ের প্রতি একটি নৈতিক বৈধতা তৈরি করে।’
টিআইবির সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে কালোটাকার পরিমাণ জিডিপির ১০ থেকে ৩৮ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কালোটাকার পরিমাণ যদি ৪০ শতাংশও হয় তাহলে এর পরিমাণ দাঁড়াত পারে ১০ থেকে ১২ লাখ কোটি টাকার মতো।
সেখানে এনবিআর তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে সব মিলিয়ে অপ্রদর্শিত প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা সাদা করা হয়েছে। যা কালোটাকার মোট পরিমাণের নগণ্য একটি অংশ। এই সামান্য পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের জন্য নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়াকে সমালোচনা করেছেন তারা।
অন্তর্বর্তী সরকারের হঠাৎ কেন ইউটার্ন?
২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর উচ্চস্বরে ঘোষণা করা হয়েছিল, তারা কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করবে এবং কর ব্যবস্থার সংস্কার আনবে। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় আসার এক মাসের কম সময়ে অর্থাৎ গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর ১৫ শতাংশ কর প্রদানের মাধ্যমে কালোটাকা সাদা করার বিধান বাতিল করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তার আগে গত ২৯ আগস্ট দুপুরে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের এই বিধানটি বাতিলের তথ্য জানান। এরপরই এনবিআর বিধানটি বাতিল করে। এর ঠিক ১০ মাস পর সোমবার (২ জুন) প্রস্তাবিত বাজেটে এলাকাভিত্তিক জমিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে আবাসন খাতে অপ্রদর্শিত আয় তথা কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বহাল রাখার প্রস্তাব করেন অর্থ উপদেষ্টা। অর্থাৎ আগামী ১ জুলাই থেকে বর্গমিটারের পরিবর্তে বর্গফুট হিসাবে কর দিতে হবে।
তবে এ ধরনের বিল্ডিং বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনা কিংবা নির্মাণের জন্য বিনিয়োগ করা টাকা যদি এখন পর্যন্ত বলবৎ অন্য কোনও আইনের অধীন কোনও অপরাধমূলক কার্যক্রম থেকে উদ্ভূত হয় বা কোনও অবৈধ উৎস থেকে উদ্ভূত হয় তাহলে সে অর্থ এ সুবিধার আওতায় আসবে না। চলতি অর্থবছরে এসব অবৈধ আয় এ খাতে বিনিয়োগের বিষয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ ছিল না। তবে প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী আগামী অর্থবছর থেকে এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে। এছাড়া অর্থের উৎস বৈধ না হলে আইনের এ ধারায় সুবিধা প্রযোজ্য হবে না। এছাড়া একাধিক বিল্ডিংয়ের মালিক হলে ২০ শতাংশের বেশি কর দিয়ে প্রদর্শন করা যেত, এ সুযোগও বাতিল করা হয়েছে এবার। গোপন করা আয় ১৫০ শতাংশ কর দিয়ে প্রদর্শন করার সুযোগও বাতিল করা হয়েছে। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নির্মিত বিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশের বেশি কর দিয়ে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শন করা যেত, আগামী ১ জুলাই থেকে এটি ৫০ শতাংশ কর দিয়ে প্রদর্শন করা যাবে।
অর্থ বিলে (২০২৫) বলা হয়েছে, ঢাকার গুলশান মডেল টাউন, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা ও দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত দুই হাজার বর্গফুটের অধিক আয়তনবিশিষ্ট বিল্ডিং বা অ্যাপার্টমেন্ট আয়তনের বিল্ডিং নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুটে ৯০০ টাকা এবং অ্যাপার্টমেন্ট কিংবা ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে। এভাবে এলাকাভিত্তিক করহার নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
সে হিসাবে দুই হাজার বর্গফুট আয়তনের কোনও বিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে এ বিশেষ বিধানের সুযোগ নিতে হলে কর দিতে হবে ১৮ লাখ টাকা। দুই হাজার বর্গফুট আয়তনের কোনও বিল্ডিং, অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে কর দিতে হবে ৪০ লাখ টাকা।
সরকারের ব্যাখ্যা
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়নি বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, কোনও কারণে কারো অপ্রদর্শিত টাকা থাকলে সেগুলো প্রদর্শনের একটা বিধান রাখা হয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হওয়ায় তা পুনর্বিবেচনা করবে সরকার। এটি করে ফেলে আমরা খুব ভালো জিনিস করে ফেলেছি এমনটি নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মঙ্গলবার (৩ জুন) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
একই প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেন, ‘গত বছর (আগস্ট ২০২৪) থেকে কালোটাকা বৈধ করার বিশেষ সুযোগ পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে। এবারও তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে।’
তবে তিনি জানান, প্রস্তাবিত বাজেটে কেউ যদি অপ্রদর্শিত অর্থ দিয়ে কোনও ফ্ল্যাট বা জমি কেনেন, তাহলে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কিছুটা বাড়তি হারে কর দিয়ে সেটি বৈধ করতে পারবেন। একইসঙ্গে যদি কেউ নিজের নামে থাকা জমিতে অপ্রদর্শিত অর্থে বাড়ি নির্মাণ করেন, তাহলে তাকে দ্বিগুণ হারে কর দিতে হবে। এই অতিরিক্ত কর পরিশোধ করলেই তার বিনিয়োগ আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে না।
তিনি বলেন, ‘এটা মূলত কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নয়। বরং নির্দিষ্ট খাতে অতিরিক্ত কর দিয়ে যেকোনও অপ্রদর্শিত অর্থ ব্যবহারের একটা পথ রাখা হয়েছে।’
সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর চেয়ারম্যান স্পষ্ট করে জানান, শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের ওপর কোনও কর আরোপ করা হয়নি। এটি একটি ভুল ব্যাখ্যা বা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য। শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের অর্থ করযোগ্য নয় এবং সেটিকে করের আওতায় আনার কোনও পরিকল্পনাও নেই।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকেই দেশের জাতীয় বাজেটে কালোটাকা সাদা করার বিধান রাখা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ২২ বার এ সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যদিও কালোটাকার পরিমাণের তুলনায় যৎসামান্য অংশই কর দিয়ে সাদা করা হয়।
আগের সরকারের অভিজ্ঞতা
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন আগের সরকার ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছিল ‘কোনও প্রশ্ন না করে’ মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে। কিন্তু তাতে কাঙ্ক্ষিত অর্থ আসেনি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর তথ্য অনুযায়ী, সেই স্কিমে মাত্র ১২ হাজার কোটি টাকার মতো আয় প্রদর্শিত হয়, যা মোট রাজস্ব আয়ের তুলনায় নগণ্য।
অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যারা নিয়মিত কর দেন, তারা এমন সিদ্ধান্তে নিরুৎসাহিত হন। কারণ এতে অসৎ আয়ের জন্য ইনসেনটিভ তৈরি হয়। একইসঙ্গে কর প্রশাসনের ওপর আস্থার সংকট দেখা দেয়।’
রাজনৈতিক ব্যাকড্রপে কালো টাকার বৈধতা?
বিশ্লেষকদের একাংশ বলছে, দেশের আসন্ন রাজনৈতিক সমঝোতা এবং ভবিষ্যৎ নির্বাচনের প্রসঙ্গ মাথায় রেখেই অন্তর্বর্তী সরকার এই ধরনের সুবিধা চালু করছে। কেউ কেউ মনে করছেন, সরকার সম্ভবত পুঁজি বাজার ও আবাসন খাত চাঙা করতে চাচ্ছে, কারণ অতীতে এসব খাতেই কালো টাকা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হতো।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে যাত্রা শুরু করা একটি সরকার কীভাবে এমন একটি সিদ্ধান্ত নেয়, অন্তর্বর্তী সরকারের ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক’ ভাবমূর্তিতে বাজেটের এই ঘোষণা বড় ধাক্কা বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখলে এটি একদিকে যেমন অর্থনৈতিক বৈষম্যকে উৎসাহিত করবে, তেমনি কর ন্যায্যতা ও সামাজিক সুবিচারের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক বার্তা দেবে।
এখন দেখার বিষয়, জনমতের চাপে সরকার সিদ্ধান্তটি পরিবর্তন করে, নাকি এটিই হবে তাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে আপস করে নেওয়া প্রথম বড় সিদ্ধান্ত।