সুরমা টিভি ২৪ নিউজ ডেস্ক:
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা মানুষকে সঠিক পথের দিশা দিতে গিয়ে পূর্ববর্তী সমাজগুলোর ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা ও কাজের বর্ণনা দিয়েছেন, যাতে মানুষ শিক্ষা নিতে পারে।
মুশরিকরা তার একটি অংশ আল্লাহর নামে এবং অপরটি তাদের দেব-দেবীদের নামে উৎসর্গ করত।
সুরা আল-আনআমের ১৩৬ নং আয়াতে মুশরিকদের এক অদ্ভুত প্রথার উল্লেখ আছে, যেখানে তারা শস্য ও গবাদিপশুর একটি অংশ আল্লাহর জন্য এবং অপরটি তাদের কথিত শরিকের জন্য নির্ধারণ করত। এই আয়াত ও এর তাফসির আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়—আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা কত বড় ভুল, মনগড়া ধর্মীয় রীতিনীতির পরিণতি কী ভয়াবহ হতে পারে।
আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ যেসব শস্য ও পশু সৃষ্টি করেছেন, মুশরিকরা তার একটি অংশ আল্লাহর নামে আর অপরটি তাদের দেব-দেবীদের নামে উৎসর্গ করত।
আল্লাহ যে শস্য ও গবাদি পশু সৃষ্টি করেছেন, তারা তার মধ্যে আল্লাহর জন্য একটি অংশ নির্দিষ্ট করেছে। সুতরাং তারা নিজ ধারণা অনুযায়ী বলে, এ অংশ আল্লাহর এবং এটা আমাদের শরীকদের (অর্থাৎ দেব-দেবীদের)। অতঃপর যে অংশ তাদের শরীকদের জন্য, তা (কখনও) আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, আর যে অংশ আল্লাহর জন্য, তা তাদের শরীকদের কাছে পৌঁছে। তারা যা স্থির করে নিয়েছে তা কতই না নিকৃষ্ট!
এখান থেকে ১৪৪ নং আয়াত পর্যন্ত আরব মুশরিকদের কতগুলো ভিত্তিহীন রসম-রেওয়াজ বর্ণনা করা হচ্ছে। তারা যৌক্তিক ও জ্ঞানগত কোনও ভিত্তি ছাড়াই বিভিন্ন কাজকে নানা রকম মনগড়া কারণে হালাল বা হারাম সাব্যস্ত করেছিল, যেমন নিষ্ঠুরভাবে সন্তান হত্যা। তাদের কারও কন্যা সন্তান জন্ম নিলে তাকে নিজের জন্য লজ্জার বিষয় মনে করত। তাই তাকে মাটির নিচে জ্যান্ত পুঁতে রাখত। অনেকে কন্যা সন্তান জীবিত কবর দিত এ কারণে যে, তাদের বিশ্বাস ছিল, ফিরিশতাগণ আল্লাহর কন্যা। তাই মানুষের জন্য কন্যা সন্তান রাখা সমীচীন নয়। অনেক সময় পুত্র সন্তানকেও খাদ্যাভাবের ভয়ে হত্যা করত। অনেকে মান্নত করত, আমার দশম সন্তান পুত্র হলে তাকে দেবতা বা আল্লাহর নামে বলি দেব।
এছাড়া তারা তাদের শস্য ও গবাদি পশুর ক্ষেত্রেও আজব-আজব বিশ্বাস তৈরি করে নিয়েছিল। তার একটি এ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। তারা তাদের ক্ষেতের ফসল ও গবাদি পশুর দুধ বা গোশতের একটা অংশ আল্লাহর জন্য ধার্য করত (যা মেহমান ও গরীবদের পেছনে খরচ করা হত) এবং একটা অংশ দেব-দেবীর নামে ধার্য করত, যা দেব-মন্দিরে নিবেদন করা হত এবং তা মন্দির কর্তৃপক্ষ ভোগ করত। প্রথমত আল্লাহর সঙ্গে দেব-দেবীদেরকে শরীক করে তাদের জন্য ফসলাদির অংশ নির্ধারণ করাটাই একটা বেহুদা কাজ ছিল। তার উপর অতিরিক্ত নষ্টামি ছিল এই যে, আল্লাহ নামে যে অংশ রাখত, তা থেকে কিছু দেবতাদের অংশে চলে গেলে সেটাকে দূষণীয় মনে করত না।
পক্ষান্তরে দেবতাদের অংশ থেকে কোনও জিনিস আল্লাহর নামের অংশে চলে গেলে সঙ্গে-সঙ্গে তা ওয়াপস নিয়ে নিত। এমনিভাবে যদি দুর্ভিক্ষ দেখা দিত বা অন্য কোন কারণে ফসলহানি হত, তখন আল্লাহর ভাগেরটা নিজেরা খেয়ে ফেলত, কিন্তু দেব-দেবীর ভাগে হাত দিত না। তারা বলত, আল্লাহর তো কোন অভাব নেই, কিন্তু আমাদের দেবতাদের অভাব আছে। তারা এমনই অজ্ঞতার জগতে বাস করত যে, চিন্তা করত না সেই দেবতাগণ মাবুদ হলে তাদের অভাব থাকে কি করে এবং অভাব থাকলে তারা মাবূদ হয় কি করে। বস্তুত অন্ধ বিশ্বাসে যাদের মন-মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন থাকে, এ রকম সুস্পষ্ট স্ববিরোধিতা ও মোটা দাগের বিভ্রান্তিও তাদের চোখে ধরা পড়ে না।
তাদের কর্মপদ্ধতির মধ্যে একটি মারাত্মক বৈষম্য ছিল—যদি আল্লাহর নামে নির্ধারিত অংশ থেকে কিছু তাদের দেব-দেবীর অংশে চলে যেত, তাহলে তারা তা মেনে নিত। কিন্তু উল্টোটা হলে—অর্থাৎ দেবতাদের অংশ থেকে কিছু আল্লাহর অংশে গেলে, তারা তা গ্রহণ করত না এবং ফিরিয়ে নিয়ে যেত।
এছাড়াও তারা মনে করত, আল্লাহর অভাব নেই, তাই তার অংশ খেয়ে ফেললেও সমস্যা নেই; কিন্তু দেব-দেবীরা দরিদ্র! এই ধরনের যুক্তিহীন ও শরীক ভিত্তিক চিন্তা-চেতনা ছিল তাদের ধর্মীয় রীতিনীতির মূল ভিত্তি।
এটি প্রমাণ করে যে, তারা নিজেরাই বুঝতে পারত না যে, যারা নিজের অভাব পূরণ করতে পারে না, তারা কিভাবে ইলাহ বা উপাস্য হতে পারে? এ ধরনের চিন্তা ও কর্মপদ্ধতি কেবল অজ্ঞতা নয়, বরং এক গভীর আত্মপ্রবঞ্চনা ও যুক্তিহীনতার পরিচয়।
এই আয়াত আমাদের শিক্ষা দেয়, মানুষের তৈরি মনগড়া রীতি-নীতি ও বিশ্বাস কখনোই আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা বা তার সৃষ্টির অংশ অন্য কারো নামে উৎসর্গ করা মারাত্মক গুনাহ। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ ও যুক্তিভিত্তিক ধর্ম, যেখানে প্রতিটি বিশ্বাস ও আমলের ভিত্তি রয়েছে কুরআন ও সহিহ হাদীসের ওপর। অতএব, মুসলিম হিসেবে আমাদের উচিত—সব ধরনের ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে বিরত থাকা এবং শুধুমাত্র আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জীবন গঠন করা।