সুরমা টিভি ২৪ নিউজ ডেস্ক:
ন্যানো ইউরিয়া সার উদ্ভাবন করে সাড়া ফেলেছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জাবেদ হোসেন খান। তার উৎপাদিত ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহারে এক বিঘা জমিতে ধান আবাদে খরচ হবে মাত্র ২৩০ টাকা; সেইসঙ্গে বৃদ্ধি পাবে ফলন। এতে লাভবান হবেন দেশের কৃষক। কৃষিতে এই সার ব্যবহারে বছরে সাশ্রয় হবে ২২ হাজার কোটি টাকা।
যবিপ্রবির ন্যানো ইউরিয়া সারে এক বিঘা জমিতে ধান আবাদে খরচ হবে মাত্র ২৩০ টাকা।
গবেষকের দাবি, তিনি বিশ্বে প্রথম এ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করলেও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এখনও প্যাটেন্ট (একচেটিয়া অধিকার) নিতে পারেনি। যে কারণে কৃষকের হাতে এ উদ্ভাবন পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, এ প্রযুক্তি কৃষকের হাতে পৌঁছাতে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে সবধরণের সহযোগিতা করা হবে।
জানা যায়, কোনো বস্তুকে ক্ষুদ্র আকারে তৈরি করাকে বলে ন্যানো প্রযুক্তি। ইউরিয়া সারের অণুগুলোকে অতি ক্ষুদ্র আকারে তৈরি করলে সেটি হয় ন্যানো ইউরিয়া। ন্যানো গাছের পাতার ছোট ছোট ছিদ্র দিয়ে দ্রুত ঢুকতে পারে। যে কারণ পরিমাণ কম লাগে এবং সম্ভাব্যতা অনেক বেশি থাকে। বাংলাদেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশে বসেই ন্যানো ইউরিয়া তৈরি করেছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাভেদ হোসেন খান। সাত বছর গবেষণার ফল এই সার। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এখনও প্যাটেন্ট নিতে পারেননি।
উদ্ভাবক ড. জাভেদ হোসেন খান বলেন,২০১৯ সালে আমিই প্রথম ন্যানো ইউরিয়া সার উৎপাদন করি। এরপর দুই বছর ফিল্ড ট্র্যায়েলের পর আমেরিকান জার্নালে পাবলিকেশন করি, সেইসঙ্গে বাংলাদেশে প্যাটেনের জন্য আবেদন জমা দেই। আমরা জমা দেয়ার দুই বছর পর ভারত সরকারিভাবে ন্যানো ইউরিয়া তৈরি শুরু করে। আমি আমাদের সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ করি। ফের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্যাটেন জমা দেই, যোগাযোগ করি তারা এগিয়ে আসেনি।
তিনি আরও বলেন, ‘২০২২ সাল পর্যন্ত প্রচেষ্টা চালিয়েও সফল হতে পারিনি। এরমধ্য ভারত তাদের ন্যানো ইউরিয়া ২৫টি দেশে রফতানি শুরু করে। এমনকি তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার তা আমদানি করারও প্রক্রিয়া চালিয়েছিলো।
উদ্ভাবক ড. জাভেদের দাবি, সাধারণ ইউরিয়ার থেকে অধিক শক্তিশালী ন্যানো। এতে অপচয় কম। তা ছাড়া গাছে দ্রুত নাইট্রোজেন সরবরাহেও ন্যানো ইউরিয়া এগিয়ে। স্বাভাবিক ইউরিয়ায় এক বস্তায় যে শক্তি তা ন্যানো ইউরিয়ার ৫০০ মিলি লিটারে পাওয়া যাবে। মূলত সারের মূল শক্তি নাইট্রোজেনকে ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে ৫০০ মিলি লিটারের শক্তিশালী সলিউশনে রূপান্তরিত করা হয়েছে। ন্যানো ইউরিয়া লাভটা হচ্ছে ৫০ কেজি ইউরিয়া সার কিনতে হচ্ছে না, যা বাইরে থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। যার দাম অনেক বেশি। তাছাড়া ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহার করলে ৮ থেকে ১৪ শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ড. জাভেদ হোসেন খান বলেন,সারা বিশ্বে যুদ্ধময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ইউরিয়া আমদানি ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে। এখন আমরা যদি আত্মনির্ভরশীল হই। আমরা যদি ন্যানো ইউরিয়া উৎপাদন করে কৃষকের হাতে তুলে দিতে পারি তাহলে ৬৬ শতাংশ ইউরিয়া আমদানি হ্রাস হবে। যা আমাদের হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষা করবে।
তিনি বলেন,দেশে সহজলভ্য রাসায়নিক উপাদান দিয়ে স্বল্প পরিসরে ন্যানো ইউরিয়া সার কারখানা করা সম্ভব। দেশে বিদ্যমান ক্যামিকেল দিয়ে পর্যাপ্ত ন্যানো ইউরিয়া উৎপাদন সম্ভব। ছোটখাটো ইন্ডাস্ট্রি দিলেই হবে। সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানি এগিয়ে এলে এটা দ্রুত বাজারজাত সম্ভব হবে।
এ ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হবে আমদানিকারক সিন্ডিকেট ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। এই বাধা পেরিয়ে এগুনো সম্ভব হলে কৃষি ক্ষেত্রে নতুন বিপ্লব আসবে বলে জানান ড. জাভেদ।
এ দিকে এ বছর যশোরের বেশকিছু চাষি ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহার করে ধান উৎপাদন করেছেন।
সরেজমিনে মাঠে গিয়ে দেখা যায়, ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহারে ক্ষেতগুলোয় ভালো ফলন এসেছে। কম খরচে উৎপাদন ভালো হওয়ায় খুশি চাষিরা।
আমিনুর রহমান নামে এক চাষি বলেন, ‘কৃষকরা নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করছে। আমরা কয়েকজন ন্যানো ইউরিয়া সার ব্যবহার করেছি।
তিনি আরও বলেন, আমি সাধারণ ইউরিয়া ও ন্যানো ইউরিয়া দুটি দিয়ে ধানের আবাদ করেছি। তবে ন্যানো ইউরিয়া দেয়া জমির ধানটি বেশি ভালো হয়েছে। সাধারণ ইউরিয়া দেয়া জমিতে ধান গাছে অতিরিক্ত পাতা হয়েছে, গাছে কোনো শক্তি নেই। তা ছাড়া ধানের পরিমাণ কম।
জাকির আলী নামে অপর এক কৃষক বলেন, ‘ন্যানো ইউরিয়া দেয়া জমির ধান গাছগুলো একটু ছোট এবং গাছের পাতা কম। সেইসঙ্গে প্রচুর ধান। সাধারণ ইউরিয়া সারের জমিতে বিঘায় ২২ মণ ধান হলে ন্যানো ইউরিয়া দেয়া জমিতে বিঘায় ২৫/২৬ মণ ধান হবে বলে আশা করছি।
তিনি বলেন, ‘কোনো সরকার সরাসরি বা কোম্পানি দিয়ে এ সার বাজারজাত করলে আমরা কৃষকরা লাভবান হবো।
ন্যানো ইউরিয়াকে কৃষক পর্যায় নিতে গবেষক ড. জাভেদকে সবধরণের সহযোগিতা করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল মজিদ।
তিনি বলেন,এটি বাজারজাত করতে যে ধরণের ইকুইপমেন্ট ও ফান্ডিং লাগবে সেটা পেতে আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলবো। সেটা পেলে এ সার কৃষক পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
গবেষকের তথ্য অনুযায়ী, এক বিঘা ধান উৎপাদনে ন্যানো ইউরিয়ার খরচ মাত্র ২৩০ টাকা। এতে কৃষক লাভবান হবেন। এ অবস্থায় ন্যানো ইউরিয়া বাজারজাত হলে আমাদের আমদানি নির্ভরতা কমবে। এর ফলে বছরে ২২ হাজার কোটি টাকার সাশ্রয় করতে পারবে সরকার।
প্রসঙ্গত, প্রতিভাবান গবেষক ড. জাভেদ ও তার টিম ন্যানো ইউরিয়ার পাশাপাশি ন্যানো ডিএপি সার, ন্যানো এনপিকেএস সার, ন্যানো কসমেটিক, ন্যানো ফিস ফিড, ন্যানো অগ্নি প্রতিরোধী রঙসহ ৯ ধরণের পণ্য আবিষ্কার করেছেন; যা বাজারজাত হলে দেশের অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখবে।